নগর ভাবনা

ছুটি শেষে অচল ঢাকার প্রত্যাবর্তন

Looks like you've blocked notifications!

রাজধানীতে নানা পদের দোকান ও প্রতিষ্ঠানের নামের আগে প্রায়ই দেখবেন বিভিন্ন অঞ্চলের নামজুড়ে দেওয়া আছে। যেমন বিক্রমপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এমন নানা অঞ্চলের নামসহ সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে গোটা ঢাকাতেই। এগুলো এই সমাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে ইঙ্গিত করে, সেটা হলো ঢাকায় যারা থাকে, ব্যবসা করে, জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের অধিকাংশই ঢাকাকে আপন ভাবে না। তারা থাকে ঢাকায়, কিন্তু মন পড়ে থাকে তাদের পৈতৃক ভিটায়। এটা দোষের কিছু নয়। এমনটা হওয়ার কারণ তারা নিজেদের অঞ্চল ছেড়ে আসতে চায়নি, তাই তারা সেটা ধরে রাখে ভিন্ন পন্থায়। এই যে প্রত্যেক ঈদে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে, নিজনিজ গ্রামের বাড়ি যায়, সেটাও একই কারণে, ঢাকা তাদের আপন বা শেকড় নয়। বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে মূল উৎপাটন করে মানুষ ঢাকায় আসে মূলত অর্থ উপার্জনের জন্যই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলি, আর আয়-উপার্জন, তার সিংহভাগই এই শহরকেন্দ্রিক। অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থের বিষয়টি তো আছেই।

তাহলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল মূলত তিনটি কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আবাস গড়ে বা আসতে বাধ্য হয়: অর্থ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এক কোটি আশি লাখ মানুষের শহর এখন ঢাকা। বলা যায়, মানুষ আর গাড়িঘোড়ার ভারে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে ধুকছে ৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকা। যে পরিসর আছে এই শহরে, তার তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি গাড়ি চলাচল করছে প্রতিদিন। যার কারণে ঘণ্টায় অতিক্রম করা যাচ্ছে গড়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী এতে দৈনিক নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা, আর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকার গতি ঠেকে যাবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটারের ঘরে। হাঁটলেও এর চেয়ে বেশি পথ অতিক্রম করা যায়।

কর্মঘণ্টা আর আর্থিক ক্ষতির বাইরে আমরা যদি অসুস্থ রোগী পরিবহন, নারী ও শিশুদের যাতায়াতে ভোগান্তি ছাড়াও স্বাস্থ্যঝুঁকি, বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করি তাহলে ঢাকার অচলাবস্থাকে দোষারোপ ছাড়া আর কিছুই করা যায় না। এরই ফাঁকে নানা মাত্রার দুর্নীতি, খাবারে ভেজাল, চুরি-ছিনতাই, সরকারি ও বেসরকারি চাঁদাবাজি ইত্যাদি তো আছেই। আমাদের সবার অভিজ্ঞতাতেই আছে, মিছিল-মিটিংয়ের এই ঢাকায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেও অনেক সময় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। জলাবদ্ধতার কারণে ১০ মিনিটের পথ আপনার দেড় ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। আর বিষফোঁড়ার মতো যদি যোগ হয় ভিআইপি মুভমেন্ট, তাহলে এই জট খুলতে অতিরিক্ত আরো আধঘণ্টা যোগ করতেই হবে।

এক হাজার ৩৫৩ বর্গ কিলোমিটারের এই নগরী আদতে এক অচল নগরী, এখানে বাধ্য হয়ে মানুষ আসে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। কিন্তু সুযোগ পেলেই তারা ছুটে পালায়, হাফ ছেড়ে বাঁচে। সুযোগের নাম ঈদের ছুটি। প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকামুখী হচ্ছে মানুষ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ছুটির তিন-চারদিন ঢাকার রাস্তায় সচল গাড়ি দেখা গেলেও, তা দ্রুতই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। ঢাকা অচল হচ্ছে পুনর্বার। এমন স্থবিরাবস্থার পেছনে মোটামুটি দুটি কারণকেই চিহ্নিত করা যায় : এক হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্বিতীয় হলো এই নগরকে বাসযোগ্য করার জন্য সদিচ্ছার অভাব।

নগরবিদরা বলেন, একটি শহরের মোট আয়তনের তুলনায় রাস্তা থাকতে হয় ২৫ ভাগ। আর সেখানে ঢাকায় রাস্তা রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। তার ওপর প্রত্যেক দিন কয়েক হাজার করে নতুন প্রাইভেট কার রাস্তায় নামছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অবস্থা শোচনীয়। এমন অবস্থায় যুক্ত হয়েছে অ্যাপভিত্তিক গাড়ি ও মোটরসাইকেল। সবাই যেন বুড়ো ঢাকার কাঁধে সওয়ার হয়ে লাভবান হতে চায়, কিন্তু দেখছে না, বুড়োর প্রাণ ওষ্ঠাগত।        

পরিকল্পনাবিদরা পরিকল্পনা করবেন: কী করে নগরের নানা সুযোগসুবিধা বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, কোন কোন স্থাপনা এখান থেকে সরে যাবে, কোন এলাকা দিয়ে রাস্তাঘাট প্রশস্ত হবে ইত্যাদি। আর রাজনীতিবিদরা তাঁদের সদিচ্ছা দিয়ে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, দখলদারদের বিতাড়ন, দুর্নীতিগ্রস্ত গণপরিবহন মালিকদের দুষ্টু চক্রের মূল উৎপাটন, রাস্তায় নতুন যান নিয়ন্ত্রণ, সৎ-কর্মঠ লোক নিয়োগ ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন। তাহলেই স্বস্তি নেমে আসবে শহরে। ঈদের ছুটিতে যেমনটা থাকে।

কথায় বলে, শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি, অর্থাৎ বড় ও ভালো কাজে বহু রকম বাধাবিপত্তি আসবেই, সেসবকে উপেক্ষা করে, দরকার হলে উড়িয়ে দিয়ে এই ঢাকাকে সচল করার উদ্যোগ গ্রহণ করতেই হবে। নয়তো ঢাকা পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে। একটি ঘটনা বলে এই লেখা শেষ করছি : একবার শান্তিনিকেতনে অবস্থিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক সুইডিশ যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়। যুবক কথায় কথায় জানালেন, তিনি ঢাকায় এসেছিলেন, কিন্তু ভিসার মেয়াদ অনেক কম সময়ের হওয়ায় তিনি চলে এসেছেন ভারতে, এখানে যেহেতু ভিসার মেয়াদ বেশি, তাই ভর্তিও হয়ে গেছেন বিশ্বভারতীতে, সঙ্গীতে স্নাতকোত্তর করতে। আরো বললেন, ঢাকা ভীষণ রকম যানজটের নগরী। গাড়ি এক কদমও সামনে বাড়ে না। আর রাস্তায় কদম বাড়ালেও ভিড়ের চোটে হাঁটা যায় না। সেই তুলনায় শান্তিনিকেতনেই অনেক শান্তি।

ঢাকাকে আমরা শান্তিনিকেতন বানাতে চাই না। কিন্তু যানজট নামের অশান্তি অন্তত দূর হোক, অচল ঢাকা সচল হোক, সেটাই চাই আপাতত।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।